চুয়াডাঙ্গা জেলার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির গল্প
Spread the love

চুয়াডাঙ্গা জেলার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির গল্প

লেখক  রাজিব আহমেদ

বয়স ৯০ পেরুলেও এখনো যথেষ্ট সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম আছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তিত্ব খন্দকার মেজবাহ-উদ দারাইন। মুখের বেশ কয়েকটি দাঁত যেমন অক্ষত আছে, তেমনি টনটনে তাঁর স্মৃতিশক্তি। বর্তমানে ছোট ছেলের সংসারে ঢাকায় বসবাস করলেও আলমডাঙ্গার ঘোষবিলা গ্রামের জন্য প্রতিনিয়ত তাঁর মন কাঁদে… অবোধ শিশুর মতো ছুটে যেতে চান পিতৃভূমিতে।

খন্দকার মেজবাহ-উদ দারাইন-এর বাবা ছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার খন্দকার আবু সালেহ, মাতা ফাতেমা বেগম। তিন ভাই তিন বোনের সংসারে তিনি ভাইদের মধ্যে তৃতীয় আর সবার মধ্যে পঞ্চম সন্তান। তাঁর সবচেয়ে ছোট বোন- যিনি বয়সে তাঁর চেয়ে ২০ বছরের ছোট, তিনিও বহু আগে প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু মেজবাহ-উদ দারাইন দিব্যি ‍সুস্থ ও স্বাভবিক জীবনযাপন করছেন।

জন্মতারিখ বা সন সম্পর্কে সুনিদিষ্টভাবে কিছু বলতে না পারলেও স্মৃতি হাতড়িয়ে তিনি জানান, ১৯৪৯ সালে ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু থানার জোড়াদহ হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। স্কুল ছিল বাড়ি থেকে সাত মাইল (মানে প্রায় দশ কিলোমিটার) দূরে। এই পথটুকু চলার জন্য তখন কোনো যানবাহন পাওয়া যেতো না, তাছাড়া পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ততটা সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না যে, সাইকেল কিনে দেওয়া হবে। সঙ্গত কারণেই প্রতিদিন ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে পায়ে হেঁটে দূরবর্তী স্কুলের পথে রওনা দিতেন, আবার ফিরতেনও হেঁটে হেঁটে, মানে প্রতিদিন কমপক্ষে চৌদ্দ মাইল হাঁটতে হতো।

মেট্রিক পাস করার পর ঢাকায় এসে আইএসসি পাস করে মেধার জোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু তিনি যখন মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখনি হঠাৎ বাবা মারা যান। এতে পারিবারিক অবস্থা এতোটাই সঙ্গীন হয়ে পড়ে যে, ডাক্তারি পড়াটাও আর শেষ করতে পারলেন না! কেননা পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য ন্যূনতম যে খরচটুকু দরকার, সেটা দেওয়ার মতোও কেউ ছিল না। বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে কিছুদিন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করে স্বাস্থ্য সহকারি হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।

তিনি যেখানেই চাকরির পরীক্ষা দিতেন, সেখানেই মেধার স্বাক্ষর রেখে ভালো ফলাফল করতেন। কিন্তু শুধুমাত্র স্নাতক পাস করতে না পারার কারণে জীবনে অনেকগুলো ভালো চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়- যেজন্য তাঁর আফসোসের সীমা নেই।

স্বাস্থ্য সহকারি হিসেবে চাকরি করলেও পাকিস্তান আমলে চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে টুকটাক চিকিৎসা সেবা প্রদানেরও সুযোগ পান। কেননা তিন বছর মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করার সুবাদে তিনি ডাক্তারিবিদ্যার অনেককিছুই জানতেন। তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী অপেক্ষকৃত তরুণ চিকিৎসকেরাও তাঁর এই যোগ্যতাকে বিশেষ সমীহ করতেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি দীর্ঘকাল ডা. মার্টিন হীরক-এর প্যাথলজিক্যাল সেন্টারে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করে রোগীদের রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করেছেন।

দীর্ঘজীবনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজীবন সুস্থ থাকতে চাইলে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি সারাজীবনই পরিমিত খাদ্যগ্রহণ করেছেন। যথাসম্ভব প্রাকৃতিক খাবার খেয়েছেন। তবে আসর থেকে মাগরিব-এর ওয়াক্ত পর্যন্ত কখনোই কোনো খাদ্যগ্রহণ করেননি। ব্যতিক্রম এই নীতি অনুসরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তিনি তাঁর মাকে দেখে শিখেছেন। তাঁদের পরিবারে কেউই এই সময়টুকু খাদ্যগ্রহণ করতেন না। আজও তিনি এই নিয়ম অনুসরণ করে চলেছেন। খাবারের মধ্যে হাতে তৈরি আটার রুটি তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।

তিনি সন্ধ্যার পরপরই যৎসামান্য খেয়ে এশার নামাজের পর বিছানায় ঘুমাতে চলে যান আবার ফজরের নামাজের আগেই জেগে ওঠেন। এজন্য তাঁর কোনো এলার্ম ঘড়ির প্রয়োজন হয় না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়েই পুরো নামাজ আদায় করতেন। ইদানীং বয়সের ভারে ন্যূজ্ব হয়ে পড়ায় বসে নামাজ আদায় করছেন। তবে গোসল, খাওয়া-দাওয়া, প্রাতঃক্রিয়া সম্পাদন সব নিজেই করতে পারেন। দৃষ্টিশক্তি এখনো প্রখর, নিজে দেখে কোরান পড়তে পারেন। তিনি বলেন, সুস্থ থাকতে চাইলে একদিকে যেমন পরিশ্রম করে ঘাম ঝরাতে হবে, তেমনি রাতে বিশ্রামের সময় পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। ঘুম মানবদেহের জন্য মহৌষধের মতো কাজ করে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। তিন ছেলে খন্দকার রফিক-উদ দারাইন, খন্দকার শফিক-উদ দারাইন ও খন্দকার আশিক-উদ দারাইন আর মেয়ে তৌফিকা বেগম ও মুশফিকা বেগমকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই যার যার মতো করে সুপ্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে তিনি ও তাঁর স্ত্রী রফিকা বেগম ছোট ছেলের পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মিরপুরে বসবাস করছেন।

নিজে ভালো থাকা ও আশেপাশের মানুষজনকে ভালো রাখার বিষয়ে তাঁর পরামর্শ হচ্ছে : ১. খাদ্য নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ২. সর্বদা মানবতার কল্যাণ কামনা করতে হবে এবং সুযোগ পেলেই মানুষের উপকার করতে হবে। ৩. বাবা-মায়ের সেবা করতে হবে এবং ৪. ধর্মীয় বিধি-বিধান যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। সবশেষে জানালেন, প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিহীন ডাক্তার হয়েও তিনি জীবনে খুব কম ড্রাগস সেবন করেছেন। কেননা তিনি মনে করেন- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত এসব কেমিক্যাল মানবদেহে যত কম ঢুকবে, দেহটা তত বেশি সুস্থ ও সবল থাকবে।

সর্বশেষ খবর

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031