কক্সবাজার কেন বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না
Spread the love
দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রসৈকত আর পাহাড় নিয়ে দেশের জনপ্রিয় পর্যটনগন্তব্য কক্সবাজার। তবে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েও বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না এই সৈকত। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা দুটি সৈকত ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন লতিফুল হক।
গ্রুপ ট্যুরে সঙ্গীর অভাব ছিল না, তবু মনে হলো সমুদ্রের সঙ্গে আগে একলা সাক্ষাৎ হোক। কলাতলী বিচে হাজির হলাম একটু ‘একলা’ হওয়ার আশায়। কিন্তু আমি জানতাম না অচিরেই শুরু হবে ‘হুকুম করুন জাহাঁপনা’ সিরিজ। প্রথমে ফটোগ্রাফার, এরপর ঘোড়াওলা…এভাবে আসতেই থাকলেন। ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু বোম্বাইয়ের বোম্বেটেতে আরব সাগরের পাড়ে বসে পাওভাজি খেয়েছেন, বাঙালি তাই সৈকতে পাশে বসে খাবে; এ আর আশ্চর্য কী। তবে না করার পরও যে ঘিরে ধরার প্রবণতা, এই অভ্যাস নিশ্চয়ই ফেলুদা তৈরি করেননি। সঙ্গে জটায়ুকে বলা ফেলুদার কথা, ‘অমন সুন্দর সমুদ্রতট আবর্জনায় ভরিয়ে দিচ্ছেন,’ এটাও আমরা বেমালুম ভুলে গেছি।
কক্সবাজারের এই অভিজ্ঞতার ঠিক এক বছর পর হাজির হয়েছিলাম গোয়াতে। সেই মধ্যদুপুরে, দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে। কোনোমতে হোটেলে ব্যাগ রেখেই ছুট দিয়েছিলাম সমুদ্রসৈকতে। কেউ বিরক্ত করেনি, লোভনীয় অফার নিয়ে হাজির হয়নি; একাকী নিজের সঙ্গে সৈকতেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম ঘণ্টাখানেক।
পর্যটন সেবার অনেক বিচারেই কক্সবাজারের চেয়ে এগিয়ে ভারতের জনপ্রিয় পর্যটনরাজ্য গোয়ার সৈকতগুলো। কিন্তু লিখতে গিয়ে নিজের মতো সময় কাটানোর স্বাধীনতার কথাই মনে পড়ল আগে।
 ‘ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস’
কক্সবাজারে হোটেল, রিসোর্টের অভাব নেই। প্রতিবার যাওয়ার পরে নতুন নতুন আকাশচুম্বী ভবন আপনাকে চমকে দেবে। ইনানী হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত যখন যাবেন, মনে হবে পুরো এলাকাটাই ‘ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস’। সব সময় এখানে কোনো না কোনো হোটেল বা রিসোর্টের কাজ চলছে, পাহাড় আর সবুজ কমছে পাল্লা দিয়ে। আচ্ছা কক্সবাজারে এই যে প্রতিবছর এত হোটেল রিসোর্ট হয়, তারপরও খুঁজতে গেলে অল্প টাকার মধ্যে মানসম্পন্ন হোটেল পাওয়া যায় না কেন?
এখানে হোটেল-রিসোর্ট মানে বিরাট বড় কিছু, সাধারণ অথচ মানসম্পন্ন থাকার জায়গা দিয়েও যে পর্যটকদের আকর্ষণ করা যায়, সে ধারণাই আমাদের এখানে নেই। এ ছাড়া সলো ট্রিপ এখন সারা দুনিয়াতেই জনপ্রিয়, একাকী পর্যটকদের থাকার জন্য সব জায়গাতেই গড়ে উঠেছে হোস্টেল, ডরমিটরিসহ নানা কিছু; আমাদের প্রিয় কক্সবাজারে যার প্রায় কিছুই নেই।
হোটেল নিয়ে প্রচলিত ধারণায় আপনি বিরাট বড় ধাক্কা খাবেন গোয়ার সৈকতগুলোতে গেলে। ওখানে অবশ্যই বিলাসবহুল থাকার জায়গা আছে, তবে বেশির ভাগই ‘সাধারণ আবাসন’। গোয়াতে সৈকতের কাছে বড় বড় ভবন নেই, সৈকতঘেঁষা কিছু শ্যাক (চালাঘর) আছে কেবল। থাকার বন্দোবস্ত হয় স্থানীয়দের বাড়িতে, নিজেদের বাড়ির এক বা দোতলা পর্যটকদের জন্য ছেড়ে দেন তাঁরা। এ ছাড়া আছে প্রচুর হোস্টেল, সলো ট্রাভেলার সহজেই মাথা গোঁজার ঠাঁই পান।
দুবার গোয়ায় গেছি, দুইবারেই হাজির হয়েছিলাম ডিসেম্বরের পিক সিজনে। যে সময়ে কক্সবাজারে হাজির হলে হোটেল পাওয়ার চিন্তা আপনাকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখবে, ভাড়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। অথচ এবার গোয়াতে রুম পেয়েছিলাম মাত্র এক হাজার রুপিতে! নারকেলবাগান দিয়ে ঘেরা অপূর্ব এক বাড়ি, শীতাতপনিয়ন্ত্রণসহ দোতলায় মোটামুটি মানসম্পন্ন রুম। ডিসেম্বরের কক্সবাজার কি এটা পারবে?
কী খাই, কী খাই
যেকোনো পর্যটনস্থান তখনই সবার হয়ে ওঠে, যখন সেখানে সবার জন্য সুযোগ-সুবিধা থাকে। আপনি যদি গোয়াতে যান, দেখবেন রাস্তার ধারে ছোট ছোট সব খাবার দোকান, দামে সস্তা; অনেক বিদেশি পর্যটকও সেখানে পরিবার নিয়ে বসে খাচ্ছেন। রাস্তার পাশের দোকান হলেও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন। কোনো কোনো জায়গায় বাড়ির সামনেই ছোট্ট একটা ক্যাফের মতো বানিয়েছেন বয়স্ক পর্তুগিজ দম্পতি। খাবারের বৈচিত্র্য প্রচুর, যা চান পাবেন।
কক্সবাজারের মুশকিল হলো এখানে খাবার মানেই নামী কোনো রেস্তোরাঁ, বৈচিত্র্যও অনেক কম। অযৌক্তিক দামের কথা নাহয় ছেড়ে দিলাম।
মধ্যরাতেও একা
মধ্যরাতে আপনি যদি গোয়ার কোনো সৈকতে যান, চমকে যেতে পারেন। কেউ চুপচাপ বসে সমুদ্র দেখছে, কেউবা মৃদু গলায় গান ধরেছে; কেউবা সঙ্গীর সঙ্গে হাঁটছে, কেউ বসে আছে পাশের পানশালায়। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা নেই, যাঁর যখন খুশি, নিজের মতো করে সময়টা উপভোগ করছেন।
আপনি যদি সাম্প্রতিককালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত ভিডিওগুলো দেখে থাকেন, তাহলে কক্সবাজারের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু না বলাই ভালো। এটা নিশ্চয়ই সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন নয়, তারপরও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থানে এমন ঘটনা তো অবিশ্বাস্য।
গোয়ার ১৪ আনা পর্যটক বিদেশি, দিনে–রাতে সঙ্গীসহ বা একা সৈকতে ঘুরে বেড়ান তাঁরা। তাঁদের চোখে–মুখে তাকালে কথা বললে বুঝবেন, কতটা নিশ্চিন্তভাবে ঘুরছেন। তাঁরা কী পোশাক পরে আছেন, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না, নিরাপত্তার শঙ্কা নেই; এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকে।
স্কুটি গোয়ার প্রায় জাতীয় বাহন। মোটামুটি নির্ধারিত ভাড়ায় আপনি ঘুরে বেড়াতে পারবেন দিন চুক্তিতে। যাতায়াত নিয়ে আপনার চিন্তা নেই, ভাড়া নিয়ে অযথা দরদাম করতে হয় না। স্কুটি কেবল উদাহরণমাত্র, মূল ব্যাপার হলো কক্সবাজার এখনো পর্যটকদের জন্য যোগাযোগবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। শহরে নামার পর অটোরিকশার মিছিল আর প্রচণ্ড যানজট দেখে আপনি মিরপুর না কক্সবাজার আছেন ভুলে যাবেন।
কক্সবাজার কতটা ‘নিজের
গোয়া আর কক্সবাজার দুটোই কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের। দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রসৈকত, পাহাড় সবই আছে, তবু সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে কক্সবাজারের চেয়ে অনেক এগিয়ে ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলঘেঁষা উপকূলটি। তবে নিরাপত্তা, পর্যটকবান্ধব যাতায়াতব্যবস্থা, সস্তার হোটেল খাবারের বৈচিত্র্য—এসব ছাড়াও গোয়া কক্সবাজারকে টেক্কা দিয়েছে অন্য একটি জায়গায়। গোয়া থেকে ফেরার গল্পটা বললেই সেটা সহজে বোঝা যাবে।
 ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে চার দিন ছিলাম দক্ষিণ গোয়াতে, বিমানবন্দর উত্তর গোয়ার শেষ প্রান্তে। প্রায় ১০০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। ট্যাক্সিভাড়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার রুপি। যে বাসায় ছিলাম, তার গাড়ি সার্ভিসও আছে। কীভাবে ফ্লাইট ধরা যায় পরামর্শ চাইলাম। সে বাতলে দিল, বাসার নিচ থেকেই বাস ছাড়ে; উঠে যাও। মাঝে একবার বাস বদল করে ১২০ রুপির মতো খরচ হবে। একা মানুষ খামোখা ট্যাক্সি নিয়ে এত খরচ করবে কেন। ওকে বললাম, তোমার তো গাড়িও আছে, আমাকে বাসে যাওয়ার পরামর্শ দিলে কেন? হেসে বলল, ‘এটা তুমি মনে রাখবে আর আবার এখানে ফিরে আসবে।’
গোয়ার মানুষ তাঁদের সৈকতগুলোকে ‘ওন’ করেন, নিজের মনে করেন। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, যত পর্যটক আসবেন, তত তাঁদের অর্থনীতির জন্যই ভালো হবে। তাই গোয়ায় হাঁটতে হাঁটতে যেকোনো পথচারী বা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়, সবার কাছে আপনি ভালো ব্যবহার পাবেন। এ জন্যই প্রতিবছর শীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে দলে দলে ইউরোপীয় পর্যটকেরা গোয়াতে ভিড় করেন।
কক্সবাজারের অনেক কিছুই নেই, অনেক কিছু ঠিক করতে যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খরচও করতে হবে। তবে পর্যটকদের কেউ যে ‘ওন’ করেন না, সে সমস্যার সুরাহা হবে কীভাবে?
সূত্র :প্রথম আলো

সর্বশেষ খবর

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031